সাজেক উপত্যকা ভ্রমনের ঘুটিনাটি
সাজেকের (Sajek Valley) নাম শুনলেই মনে হয় এ-যেনো কোনো এক স্বর্গরাজ্য। ভ্রমণে যেতে অনাগ্রহ প্রকাশ করা মানুষটিও চায় সাজেককে উপভোগ করতে। বলা হয়ে থাকে ২৪ ঘন্টায় এই সাজেককে অসংখ্য রূপে দেখতে সক্ষম হন দর্শনার্থীরা। এখানকার সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য বিষয় হলো খুব কাছ থেকে মেঘ দেখতে পারা। যদিও এটি মেঘ নয়। কেবল কুয়াশা। তবুও খালি চোখে দর্শনার্থীরা একে মেঘই মনে করেন। মেঘ হোক কিংবা কুয়াশা… এতে কোনো জটিলতা নেই। জটিলতা কেবল সাজেকের অসংখ্য রূপের। একটি স্থান নিজেকে ২৪ ঘন্টায় কতভাবে সাজাতে পারে তা সাজেক না দেখলে বোঝায় যায় না।
সাজেক (Sajek Valley) সম্পর্কিত কিছু তথ্য
সাজেক ভ্যালী বর্তমানে সাজেক নামেই সকলের কাছে জনপ্রিয়। এটি মিজোরাম সীমান্তে অবস্থিত। চট্টগ্রাম বিভাগ এর রাঙ্গামাটি জেলা সর্বউত্তরের স্থান। সাজককে বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ ইউনিয়ন হিসেবে ধরা হয়। এটি বাঘাইছড়ি নামক একটি উপজেলার আওতাধীন ইউনিয়ন। ৭২০ বর্গমাইল আয়তনের এই ইউনিয়নটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনস্থানের মধ্যে একটি। পূর্বে ভারতের মিজোরাম, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির জনপ্রিয় দীঘিনালা, উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিনে রাঙামাটির লংগদুর মাঝখানে সাজেক যেনো এক অপরূপা কন্যা। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে ৭০ কিলোমিটার পথ মাড়ালেই দেখা মিলবে এই অপরূপা কন্যার। তবে দীঘিনালা থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার। প্রিয় পাঠক, সাজেকের উচ্চতা সম্পর্কে কি আপনার কোনো ধারণা আছে? না থাকলে জেনে নিন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই অপরূপার উচ্চতা প্রায় ১৮০০ ফুট। বাংলাদেশে গুটিকয়েক পর্যটন এলাকা ছাড়া প্রায় প্রতিটি এলাকাতে যেতেই অনুমতি নিতে হয়। ঠিক তেমনই সাজেক যেতে হলে অবশ্যই আর্মি ক্যাম্প এবং বাগাইহাট পুলিশের অনুমতি নিতে হবে।
কিভাবে সাজেকে (Sajek Valley) যাবেন?
সাজেক যেতে খুব ইচ্ছে করছে! কিন্তু কিভাবে যাবেন তা ঠিক করতে পারছেন না! এমন পরিস্থিতিতে পড়লে জেনে নিন সাজেকে যাওয়ার গন্তব্যপথ নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
আমরা সকলেই জানি সাজেক রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত। কিন্তু সাজেক যাওয়ার সহজ পথ হলো খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা। অতএব যুক্তি অনুযায়ী প্রথমেই আপনাকে খাগড়াছড়িতে পৌঁছতে হবে। প্রায় প্রতি ঘন্টায় ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির উদ্দ্যেশে বাস ছেড়ে যায় আপনি একা হলে সে বাসে যেতে পাবেন আথবা কার দরকার থেকে প্রাইভেট কার ভাড়া নিতে পারেন বড় গ্রুপ এর জন্য বাস, মিনি বাস, নোহা, হাইচ ভাড়া নেওয়ার সেরা মাধ্যক কার দরকার রেন্ট এ কার। আপনার পছন্দ মত যানবহনে খাগড়াছড়ির শাপলা চত্বরে এসে পৌঁছতে হবে। সেখান থেকে আপনি চান্দের গাড়ি ভাড়া করে খুব সহজেই সারা সাজেক চষে বেড়াতে পারেন। যদি তাতে কোনো সমস্যা হয় তবে সিএনজি করেও সাজেকে যেতে পারেন। কিন্তু পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথের জন্য সিএনজি খুব বিপজ্জনক। তাই নিজের গাড়ি কিংবা রেন্ট এ কার এর গাড়ি নিয়ে রিস্ক না নেওয়াই উচিত। নতুবা শান্তিতে ভ্রমণটা আর উপভোগ্য করে তুলতে পারবেন না।
সাজেক যাওয়ার পথে কি দেবদূতের দেখা মেলে?
আমরা সকলেই কমবেশি পাহাড়ি জীবনযাপন সম্পর্কে জানি। তবে সেখানকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জীবনযাপন সম্পর্কে হয়তো আমরা অনেককিছুই জানি না। সমতলে আছি বলে হাজার রকমের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে করতেই আমাদের জীবন কাটছে। ফলে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা গলিতে বাস করা উপজাতিদের জীবন সম্পর্কে আমাদের তেমন ধারণা নেই। সমতলে থাকা এই আমাদের চাইতে পাহাড়ে থাকা সহজ-সরল মানুষগুলো এখনো অনেক পেছনে পড়ে আছে।
আপনি কি জানেন সাজেক যাওয়ার পথে দেবদূতদের পাওয়া যায়?
হ্যাঁ! সত্যি বলছি। সাজেক যাওয়ার পথে অর্থ্যাৎ খাগড়াছড়ি থেকে চান্দের গাড়িতে করে যে পথটি সাজেক যাওয়ার জন্যে ব্যবহৃত হয় সেই পথটিতেই দেখা মেলে এই দেবদূতদের। সমতলে থাকা এই আমরা অপরিচিত কোনো মানুষ দেখলেই কেবল এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। হাত উঠিয়ে অভ্যর্থনা জানানোর সময়টুকু আমাদের নেই৷ আমরা ব্যস্ত আমাদের আপন জীবন নিয়ে। আরেকটু ভালো থাকার চেষ্টা আমাদের আরো ব্যস্ত করে তোলে। অথচ পাহাড়ের কোণে পড়ে থাকা সহজ-সরল ওই মানুষগুলো অল্পতেই তুষ্ট থাকে। পাশাপাশি আশেপাশের মানুষগুলোরও মনের খোরাক জোগাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। আপনি যখন সাজেকের উদ্দেশ্যে খাগড়াছড়ি থেকে চান্দের গাড়িতে চড়ে রওনা দিবেন তখনো আপনি বুঝতে পারবেন না কিছু মানুষ কতটা সহজ-সরল জীবনযাপনে তুষ্ট। পথে পথে ৭-১১/১২ বছরের শিশুরা আপনাদের হাত উঠিয়ে স্বাগতসম্ভাষণ জানাবে। আবার কখনো কখনো মিষ্টি পেঁপে এবং ডাব বিক্রির উদ্দেশ্যে হাত উঠিয়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করবে। পাহাড়ি ডাবের পানির অমৃত স্বাদ এবং জুম চাষের মাধ্যমে বেড়ে উঠা মিষ্টি পেঁপে আপনার খাদকমনকে নাড়া দিতে বাধ্য। আপনি যদি সাজেক (Sajek Valley) যাওয়ার পথে এই স্বাদ একবারও নিতে না পারেন তবে আপনি খুব বড়সড় একটা অভিজ্ঞতা মিস করতে পারেন। এই দেবদূতদের কিন্তু অল্পতেই খুশি করা যায়। সমতলে থাকা মাম্মি-ড্যাডির কিউট বেবিদের মতো তারা অতশত খুঁত ধরে না। ধরবেই বা কি করে? অপ্রাপ্তি তাদের সেই সুযোগ কেড়ে নিয়েছে। একটা চকলেট কিংবা লিচির প্যাকেট হাতে থাকলে পথে পথে যদি তাদের ছুঁড়ে মারা হয় তাহলে তাদের মুখে যে খুশির ঝলক ফুটে উঠে তাতে স্বর্গীয় সুখের স্বাদ গ্রহন করা যায়।
সাজেকে কিভাবে ঘুরবেন?
সাজেকে (Sajek Valley) ঘুরতে নির্দিষ্ট কোনো নিয়মকানুনের প্রয়োজন নেই। তবে কিছু কিছু ব্যাপার অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত। সাজেকে পৌঁছুতে বেশ সময় লাগতে পারে। সুতরাং এই দীর্ঘযাত্রার পরপরই সাজেকে ঘোরাঘুরি করার কথা চিন্তা করবেন না। এতে করে শারীরিক ক্লান্তি আপনাকে আনন্দের সাথে সাজেকে ঘোরাঘুরি করতে দিবে না। বারবার নুয়ে পড়বেন আপনি। তাই সাজেকে পৌঁছে ঘন্টাখানিক বিশ্রাম নিন। এতে করে ভ্রমণের জন্য নিজেকে চাঙ্গা করে নিতে পারবেন। যা একটি ভ্রমণকে উপভোগ্য করে তুলতে খুব প্রয়োজন। পাশাপাশি মাথায় রাখবেন কাঠফাটা রোদের মাঝে অর্থ্যাৎ ঠিক দুপুরে যেনো সাজেক দেখতে বের না হোন। প্রখর রোদে ঘোরাঘুরি করলে আপনার খারাপ লাগতে পারে। বিকেলের দিকে চান্দের গাড়ি ব্যবহার করে সাজেক অবলোকন করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ুন। গোধুলির সাজেক দেখে আপনার স্বর্গ মনে হতে পারে। সূর্যাস্তের মুহুর্ত সাজেককে স্বপ্নের স্থানে পরিণত করে। সাজেকে কিন্তু সন্ধ্যাবেলায়ও তারার দেখা মেলে! প্রথমদিকে দু’একটি…এবং রাত বাড়তে বাড়তে মাথার উপরে অসংখ্য তারা এসে হাজির হবে আপনাকে স্বাগতম জানানোর উদ্দেশ্যে। ভোরের দিকে এক ছুটে চলে যাবেন হ্যালিপেডে। উদ্দেশ্য হবে ভোরের সূর্যদয় দেখা। বিশ্বাস করুন সমতলে কিংবা শহরের দালানকোঠার ভিড়ে আপনি যে সূর্যদয় দেখেন তার সাথে সাজেকের এই সূর্যদয়ের কোনো মিল নেই। খুব অন্যরকম এই সূর্যদয়টা। না দেখার আগে কখনোই ধারণা করা যাবে না।
সাজেকে যেসব বিষয় খেয়াল রাখা উচিত
সাজেকের আলাদা নির্দেশনা অনুযায়ী বেশকিছু বিষয় খেয়াল রাখা উচিত। সাজেক যাওয়ার পূর্বে কিছু নির্দেশনা সম্পর্কে সকলেরই অবগত থাকা উচিত। কিছুকিছু প্রয়োজনীয় বিষয় এখানে তোলে ধরার চেষ্টা করলাম।
বর্তমানে দিনদিন সাজেকের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। অসংখ্য পর্যটকের আনাগোনা এই সাজেক। মানুষ ছুটি পেলেই সাজেকদর্শনে উতলা হয়ে পারে। ফলে ছুটির দিনে প্রচন্ড ভিড় হয় সাজেকে। তাই ছুটির দিনে কটেজ পেতে হলে অবশ্যই ১ মাস আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখতে হবে। এতে করে সহজেই কটেজ মিলবে এবং কোনো ঝামেলা হবে না।
পাহাড়ি এলাকা হওয়া অনেকসময় এখানে নেটওয়ার্কের ঝামেলা হতে পারে। তাই যোগাযোগ রক্ষার্থে রবি, এয়ারটেল সিমকার্ড নিয়ে যাওয়া উচিত।
আমরা কেউই চাই না অনুমতি ছাড়া কেউ আমাদের ছবি তুলুক। অন্যথায় কেউ তোলে ফেললে আমরা খুব বিরক্ত হই৷ ঠিক তেমনই অন্যরাও এই অযৌক্তিক কাজে বিরক্ত হয়। তাই স্থানীয় মানুষের ছবি তোলার আগে তাদের অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি ছাড়া ছবি তোলা যাবে না।
এখানে সেনাবাহিনী ক্যাম্পের ছবি তোলা নিষেধ। তাই এক্ষেত্রে খেয়াল রাখা উচিত।
সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র রাখবেন। বিপদেআপদে কাজে লাগতে পারে।
যারা মোটরসাইকেল করে যাবেন তারা অবশ্যই সতর্ক থাকবেন। সাজেকের রাস্তাকে কখনোই রাইডিং করার জন্য উপযুক্ত স্থান মনে করে ফিল্মি স্টাইলে রাইডিং করতে যাবেন না। এতে করে নানানরকম দূর্ঘটনার শিকার হতে পারেন।